সাম্প্রতিক সময়ে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা উদ্বেগ ও বিস্ময় তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারত সরকার মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দিচ্ছে, যাদের অনেকেই প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক এবং বৈধ পরিচয়পত্র রয়েছে।
পরিকল্পিত আটক ও জোরপূর্বক বহিষ্কার
২০২৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের আসাম, দিল্লি, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলোতে “অবৈধ বাংলাদেশি” সন্দেহে শত শত মুসলিমকে আটক করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও বিচার, শুনানি বা যথাযথ তদন্ত ছাড়াই তাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ ধরনের অভিযানের লক্ষ্যবস্তু যে বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাস্তবতা ও আটক ব্যক্তিদের ধর্মীয় পরিচয় থেকেই স্পষ্ট।
বন্দুকের ছায়ায় সীমান্ত পার
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) বন্দুকের মুখে মানুষকে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য করছে। কোনো কাগজপত্র বা যোগাযোগের সুযোগ ছাড়াই তাদের রাতের অন্ধকারে সীমান্তে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ভয় দেখানোর জন্য গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটেছে।
হাজেরা খাতুনের কাহিনি: এক বাস্তব বিভীষিকা
৬২ বছর বয়সী হাজেরা খাতুন একজন প্রতিবন্ধী নারী। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দিল্লিতেই। বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি এই অভিযানের শিকার হন। তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীরা তাকে আটক করে এবং পরিচয় যাচাইয়ের পর ভারতে ফিরিয়ে পাঠায়। ভারতে ফেরার পর হাজেরা ছিলেন আতঙ্কগ্রস্ত, শারীরিকভাবে আহত এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ জনকে গ্রহণ না করে ফেরত পাঠিয়েছে, কারণ তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগও শুরু হয়েছে। একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা ভারতের বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু এভাবে আমাদের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।”
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। তাঁদের মতে, ভারতের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং নিজস্ব সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) ও Amnesty International এটিকে একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অংশ বলে অভিহিত করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মভিত্তিক বৈষম্য ও বর্ণবাদী নীতির একটি প্রতিফলন, যা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
উপসংহার
সীমান্তে যা ঘটছে, তা শুধু দুটি দেশের সম্পর্ক নয়—এটি মানবাধিকারের, নৈতিকতার এবং নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন।
জন্মভূমি থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত হওয়া শুধু একটি ব্যক্তির নয়, একটি পরিচয়ের, একটি মর্যাদার লঙ্ঘন। এই সংকট এখনই বন্ধ করা না গেলে তা আরও গভীর মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। সময় এসেছে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই সাহসী, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।