বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডের দাবি শুধু একটি আইনি ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনীতি, ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে নতুনভাবে সামনে এনেছে।
প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশজুড়ে শুরু হয় ছাত্র ও সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, দমননীতি ও অব্যবস্থাপনার। আন্দোলন দ্রুত সহিংস রূপ নেয়, আর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ঘটনাগুলোর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। আন্দোলনের পরই শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বর্তমানে যে মামলাটি আদালতে চলছে, সেখানে অভিযোগ আনা হয়েছে যে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। প্রসিকিউশন বলছে, এই নির্দেশই শত শত প্রাণহানির জন্য দায়ী। সেই কারণেই তারা সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেছে।
বিচারপ্রক্রিয়া ও বিতর্ক
এই বিচারকে কেন্দ্র করে দুটি ভিন্নধর্মী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। একপক্ষ বলছে, এটি ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া—যে কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনতেই হবে, সে যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন। অন্যপক্ষের দাবি, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু নয়।
বিচারের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কারণ অভিযুক্ত শেখ হাসিনা বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন, এবং বিচার প্রক্রিয়া তার অনুপস্থিতিতেই চলছে। সমালোচকরা মনে করেন, অনুপস্থিত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় পূর্ণাঙ্গ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকলে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, প্রমাণ ও সাক্ষ্য যথেষ্ট শক্তিশালী। অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেননি, বরং সরাসরি প্রশাসনিক নির্দেশে প্রাণহানি ঘটার দায় এড়াতে পারেন না।
রাজনৈতিক প্রভাব
এই মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর দিক উন্মোচিত করছে—ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায়বদ্ধতার অভাব। দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে আইন ও প্রশাসনের মাধ্যমে কোণঠাসা করার প্রবণতা দেখা গেছে। বর্তমান বিচার প্রক্রিয়া যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছোঁয়া পায়, তবে সেটি ভবিষ্যতে আবারও একই চক্র পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে।
অন্যদিকে, যদি এই মামলা আইন অনুযায়ী স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়, তবে এটি হতে পারে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক—যেখানে আইন সকলের ঊর্ধ্বে অবস্থান করবে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ
আন্তর্জাতিক মহল ঘনিষ্ঠভাবে এই বিচার পর্যবেক্ষণ করছে। অনেক মানবাধিকার সংস্থা ইতোমধ্যেই উদ্বেগ জানিয়েছে যেন বিচার প্রক্রিয়াটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ থাকে। একই সঙ্গে বিদেশি সরকারগুলোও চায় বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হোক।
এই মামলার রায় তাই কেবল একজন নেত্রীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, এটি দেশের মানবাধিকার চর্চা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
উপসংহার
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দাবি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গভীর প্রতীকী মুহূর্ত। এটি ক্ষমতা, ন্যায়বিচার ও মানবতার সীমারেখা পরীক্ষা করছে। বিচারটি যদি সত্যিই আইনের শাসনের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সূচনা হতে পারে।
ন্যায়বিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন বিচার প্রক্রিয়া হবে পক্ষপাতহীন, প্রমাণনির্ভর এবং মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত। আজকের এই সংকটময় মুহূর্তে দেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি প্রতিহিংসার রাজনীতি টিকিয়ে রাখব, নাকি সত্যিকারের ন্যায়বিচারের পথে হাঁটব?